রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৯:০৮ অপরাহ্ন

পরিবর্তনশীলতার গতিপথে প্রত্যেক জীবের বিচরণ!

রাজু আহমেদ ।।
যিনি জীবনের যে রঙ দেখেছেন তিনি জীবনের সেই রঙকেই ছড়িয়েছেন! একজন অসুখী মানুষের থেকে সুখের গল্প শুনলে সে গল্পেও দুঃখের রস-দীর্ঘশ্বাস ভর করবে! যে দম্পতি অসুখী তারা বিবাহকে জীবনের সবচেয়ে বড় দুরাচার মনে করবে এবং সেটাই প্রকাশ-প্রচার করবে কিন্তু যারা সুখী তাদের দেখলেই একসাথে হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছা হবে। যিনি ভেতরে থাকেন আর যারা বাইরে নিয়ত সংগ্রাম করেন তাদের দু’পক্ষের কাছে জীবনের আলাদা আলাদা মানে আছে! জীবন যার কাছে যতখানি ধরা দিয়েছে, যে জীবন থেকে যতটুকু নিতে পেরেছে সে জীবনের সেই অংশই দেখেছে, সেটুকুর গল্প জানে এবং সেটুকুই অপরকে জানাতে পারে! এর বাইরেও যে আলো-আঁধারির খেলা থাকে, সুখ-দুঃখের মেলা বসে তা খুব কম লোকেই মানে!

একজন বেকারের কাছে এবং একজন বণিকের কাছে জীবনের মানে সমার্থক নয়! যে সম্মান-আভ্রু সযত্নে-সংগ্রামে সামলায় তার সাথে গণিকার বণিতা একপথে চলে না। যে ক্ষমতা পেয়েছে আর যারা শোষিত হচ্ছে তাদের কাছে জীবনের রুপ-রস জানতে গেলে মহাকাব্যের দ্বৈরথ অমিলেই হবে। একজন ব্যস্ত মানুষ এবং যে অলস তাদের উভয়ের কাছে জীবন সমানভাবে রঙিন নয়। যে শেখে এবং যিনি শেখায় তারাও জীবনের আলাদা আলাদা অর্থ থেকে দু’টো ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে। যে আপনার আপন এবং যে পর তাদের দু’জনের কাছে আসা এবং দূরে সরে যাওয়ার আলাদা উদ্দেশ্য থাকে। যারা দুঃখ ছুঁয়ে দেখে, বিশ্বাসভঙ্গের খেসারত দিচ্ছে কিংবা যার সময় চুরি হয়েছে তাকে নিয়ে জীবন খেলেছে বেশি। দিয়েছে কম না-কি বেশি?-সে অন্য হিসাব।

যিনি পরিবারের বোঝা, যিনি কোন সৎ মায়ের অসৎ চরিত্র দেখেছে, যে বাবা সন্তানের খোঁজ রাখেনি তাদের দুঃখগুলো হরেক রঙের কিন্তু ব্যথাগুলো একই। যে বাবা-মায়ের সন্তান বিপথগামী হয়েছে, যে সন্তান প্রত্যাশা পূরণ করার চেষ্টাটুকুও করেনি কিংবা যাদের জন্য জীবন খোয়ানো সে তারাই যদি বৃদ্ধ পিতামাতার খোঁজ না রাখে তবে জীবনের আফসোস রয়েই গেলো! যে সব পেয়েছে, পূরণ হয়েছে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, সন্তুষ্ট থেকে স্ব-অবস্থানে তার কাছে জীবনের বর্ণনা শুনলে সেখানে রাগ-ক্ষোভ কিছুই নাই। প্রাপ্তির প্রশংসা আছে। কৃতজ্ঞতার স্বীকারোক্তি আছে আর আছে জীবনের উৎকর্ষতার বর্ণনা। সেই জীবনের সাথে বস্তিতে জন্ম নেওয়া, জেলে পরিবারে বেড়ে ওঠা, গৃহহীন পরিবারের অসচতেনতায় শিক্ষা বঞ্চিত হওয়া এবং মজুর পরিবারে অপারগতায় শখ-আহ্লাদ অপূরণীয় থাকা কোন কিশোরের গল্প মিলবে না! তারা জীবনকে ভিন্ন চোখে দেখে। তারা বঞ্চনার জন্য সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্রকে বারবার দায়ী করে।

যারা জীবনের নগ্নরূপ দেখেছে, যারা হৃদয়ের ভগ্নরূপের কদর্য সয়েছে কিংবা যারা দুঃখের সাগরে বেয়েছে তরী তাদের কাছে জীবনের মানে একবুক দীর্ঘশ্বাস। তাদের গল্পগুলোতে অবহেলা আর খাদ্যকষ্টের স্পর্শ থাকে। না পাওয়ার কিংবা বঞ্চিত হওয়ার হতাশা থাকে! বৈষম্যের জন্য ক্ষোভের অগ্নিকুণ্ড মনের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলে! অথচ যারা প্রয়োজনের বেশি পেয়েছে কিংবা ক্ষমতায় কেড়েছে আরও বেশি তাদের মনে বৈষম্যের চিন্তাকে অবান্তর প্রশ্ন মনে হয়! যাদের কাছে ভোগের বিপুলা রসদ আছে, ক্ষমতার কাঠি আছে এবং ইচ্ছাপূরণের বিত্ত আছে অথচ শখ কম তাদের কাছে জীবনের বৈচিত্র বাহারিয়া! তাদের কাছে মোটিভেশনের সস্তা গল্পকে বরবাদ বাকাওয়াজ মনে হয়, অর্জনের পথকে প্রশস্ত মনে হয় এবং সবকিছু সহজ লাগে! কিন্তু যার দিনের আয়েই দিন চলে তার কাছে দু’পয়সাই অনেককিছু! সে বিশ্বনিখিলের চিন্তাকে দুশ্চিন্তা ভাবে তবে চালের দাম দুই কড়ি বাড়লে আরও গোটা দুই কালো চুল সাদার দলে চলে যায়!

জীবন আসলে কেমন? যে যেমন পেয়েছে এবং দেখেছে জীবন তেমনই! এখানে চির দুঃখীজন থাকে আবর সুখের মহাজনও আয়েশে ঘোরে। একজন না চাইতেই সব পায় আরেকজন চেয়েও কিছুই পায় না! জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে যা-কিছু ঘটে, যে যেপথে হাঁটে, শোনে এবং দেখে এসবই কালপরম্পরায় জীবনের হরেক রকমের রূপ! একভাবে, একপথে এবং একপেশে জীবন যায় না! জীবনে দুঃখের মেঘ আসে আবার কেটে যায়, সুখ আসে আবার ফাঁকি দেয়। কোথাও আটকে গেলে, নিজেকে বন্দী করলে জীবনের অনেক বন্দর অদেখাই থেকে যাবে! আজ কাজ নাই তো কাল কাজের চাপ আসবে, আজ টাকা নাই তো কাল সামর্থ হবে কিংবা আজ খাবার জোটেনি তো আগামীকাল উদ্বৃত্ত থেকে যাবে! জীবন থেমে থাকে না। সে মৃত্যুর বন্দরে পৌঁছাবেই। এই যাত্রাপথে সে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী করে এবং জীবনের নানা স্বাদ ও সম্বাদ দেয়! এক পরিবর্তনশীলতার গতিপথে প্রত্যেক জীবের বিচরণ।

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
raju69alive@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Titans It Solution